‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ কথাটি শেয়ারবাজারে হর হামেশাই শুনতে পাওয়া যায়। ইনসাইডার ট্রেডিং হচ্ছে কোম্পানির কোনো অপ্রকাশিত বা গোপন ইতিবাচক বা নেতিবাচক আর্থিক তথ্যে পুঁজিবাজারে প্রকাশের আগে আগেই জেনে তার উপর ভিত্তি করে নিজে অথবা অন্যকে তথ্যে দিয়ে শেয়ার বাই-সেল করতে সাহায্য করা। এটির মাধ্যমে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর স্বার্থ পদ-দলিত করা হয়।
বিভিন্ন কলাকৌশলের মাধ্যমে বাজারে ইনসাইডার ট্রেডিং হয়ে থাকে। পুঁজিবাজার অামাদের মার্কেটে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ খুব বেশি হয়। তবে মার্কেটের আপট্রেন্ডে এটি সবচেয়ে বেশি হয়।
‘ইনসাইডার ট্রেডিংয়ে’ কোম্পানির যে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রথমে ডিএসইর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অবহিত করার বিধান রয়েছে। সেটি না করে প্রথমে ঐ তথ্য কাজে লাগিয়ে নিজেদের নামে বা বেনাম প্রচুর শেয়ার বাই অথবা সেল করা হয় এবং নিজেদের বা সিন্ডিকেটের শেয়ার ম্যাটিউড হলে, গুজব অাকারে মার্কেটে সে তথ্য ছড়ান হয় অথবা তা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে ডিএসইতে প্রচার করা হয়।
তখন সেই তথ্যে আকৃষ্ট হয়ে যখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয় করতে থাকেন তখন বেশি দামে সিন্ডিকেট সেগুলো বিক্রি করতে থাকে। আবার বিপরীত ঘটনাও ঘটে থাকে যখন সিন্ডিকেটগুলো গুঁজব ছড়ানোর মাধ্যমে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের আগেই শেয়ার বিক্রি করে দেয়।
সব শেয়ারবাজারেই সবচেয়ে বড় অপরাধ ইনসাইডার ট্রেডিং। আধুনিক ফিন্যান্সের ইতিহাস বলে, অভ্যন্তরীণ তথ্যপ্রাপ্তির সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে শেয়ারবাজার থেকে কোটিপতি হয়েছেন বহু মানুষ। তাদের কেউ কোম্পানির উদ্যোক্তা বা পরিচালক, কেউ কর্মকর্তা-কর্মচারী, কেই অডিটার অথবা কেউ আবার কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও ইনসাইডারদের সহোযোগি টাকার বিনিময়ে। তাদের প্রত্যেকেই বাজারের সৎ বিনিয়োগকারীদের ঠকায়।
তথ্যমতে, অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক বা সিনিয়র কর্মকর্তারা কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য সম্পর্কে অগ্রীম জেনে যায়। সেই সঙ্গে ওই তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানো হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জেনে থাকেন এদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ অাছে, এরা তথ্য প্রকাশে ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করে। এসব মানুষের মধ্যেই তথ্য পাচার হয়ে যায়। আর যাদের মাধ্যমে তথ্য পাচার হয় তারাই আগাম শেয়ার কিনে রাখেন। তবে শুধু জানলেই তা ইনসাইডার ট্রেডিং বলে গণ্য হবেনা। জানার পর যদি নিজের স্বার্থ বা লাভের জন্য সেই কোম্পানির শেয়ার ট্রেড করা হয় বা তথ্যটি অপর কোনও পক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হয় তবে তা ইনসাইডার ট্রেডিং বলে গণ্য হবে।
ধরা যাক কোনও একটি প্রান্তিকে কোম্পানি ‘ক’ এর ব্যবসায় ভালো করার কারণে ইপিএস ২ টাকা থেকে বেড়ে ৪ টাকা হল। তথ্যটি জনসাধারণের নিকট প্রকাশ করার পূরবেই সাধারণত কোম্পানির বড় কর্মকর্তারা জেনে যায়। অতঃপর এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে তারা যদি শেয়ার বাই করতে থাকে তাহলে তা ইনসাইডার ট্রেডিং হবে।
অনেক সময় দেখা যায় কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালকরা নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্রোকার হাউজগুলোতে শেয়ার কেনাবেচা করে থাকে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয় স্বজনের নাম ব্যবহার করায় কোনও ঘোষণা ছাড়াই তারা শেয়ার বেচাকেনা করে। আবার কারা কারা এই কাজ করছে এবং তারা কোন কোম্পানির সাথে সম্পর্কিত সে সম্পর্কে ব্রোকার হাউজের মালিকদেরও ধারণা থাকে।
সুতরাং ওইসব একাউন্ট ধারিদের হিসাবে তাদের নিজেদের কোম্পানির বা অন্য কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করতে দেখলে ব্রোকার হাউজের মালিকরাও কোম্পানির অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করতে পারে। ফলে তারা সে অনুযায়ী নিজেরাও নামে বেনামে ওই কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করে। এভাবেই তথ্য মার্কেটে ছড়ায়।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি কত লভ্যাংশ দিতে যাচ্ছে বা আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফা কত দেখাতে যাচ্ছে এমন তথ্য হরহামেশাই ফাঁস হচ্ছে। কোম্পানির ভবিষ্যৎ ব্যবসা পরিকল্পনাও আগেই জেনে যাচ্ছেন অনেকে। এসব তথ্য জেনে শেয়ার কেনাবেচা করছেন এক শ্রেণীর শেয়ার ব্যবসায়ী।
অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশে কোম্পানির মূল্যসংবেদনশীল তথ্যই আগে থেকে গুজব আকারে বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে ইনসাইডারদের সক্রিয়তার মাত্রা যেমন বেশি, তেমনি তাদের ব্যবহার করা মানুষের সংখ্যাও বেশি। বিভিন্ন মহলে যোগাযোগের সুবাদে সে গুজব যাচাই করে দেখার সক্ষমতা রয়েছে হাতেগোনা কিছু মানুষের। তাদের পুঁজিও তুলনামূলক বড়।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা-পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জেনে নেয়। ব্যক্তি শ্রেণীর বড় বিনিয়োগকারীরাও এমনটি করে থাকেন। এ কারণে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কোনো তথ্য গোপন থাকে না।
বর্তমান বিধি অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বার্ষিক হিসাব শেষ হওয়ার দুই মাস আগে থেকে শুরু করে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে ওই হিসাব চূড়ান্তভাবে বিবেচিত, গৃহীত বা অনুমোদিত হওয়া পর্যন্ত উদ্যোক্তা, পরিচালক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী, নিরীক্ষক বা নিরীক্ষাকার্যে সম্পৃক্ত ব্যক্তি, পরামর্শক বা আইন উপদেষ্টা, কিংবা বেনিফিশিয়াল ওনার সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার ক্রয়, বিক্রয় কিংবা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তরের সুযোগ নেই।
অনেক ক্ষেত্রে লভ্যাংশ ঘোষণা আগেই বা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের আগেই ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের ফলে শেয়ারের মূল্য অনেক বেড়ে যায়। আর সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের সাথে সাথে শেয়ারটির দাম কমতে থাকে। যদিও সংবেদনশীল তথ্যটি ইতিবাচক ছিল। এর কারণ ইনসাইডার ট্রেডারদের শেয়ার আগে থেকে ম্যাচিউড ছিল। সংবেদনশীল তথ্যটি প্রকাশের সাথে সাথে তারা সেল মুডে চলে গেছে। খেয়াল করলে দেখবে সেদিন ভলিউমও বেশি হয়েছে।
‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ বন্ধের মূল দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার, কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যেমে। এই জায়গাটিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূরে দুর্বলতা অাছে। তাদেরকে অারো শক্ত হতে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ বন্ধের পদক্ষপ নেওয়া উচিৎ।
তবে বিনিয়োগ যে করবেন তারও দায়িত্ব আছে। বরং তার দায়িত্ব বেশি। কারণ লাভ লসের দায় তার কাাঁধেই যাবে। ভাল কোম্পানি বা উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন কোম্পানির ক্ষেত্রে ইনসাইডার ট্রেডিং’ অনেক কম হয় বা হয়ই না। সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের আগেই অনেক দাম বেড়েছে কিনা সেটা দেখে বিনিয়োগ করা উচিৎ। অভারভ্যালুড দামে কোন শেয়ার ক্রয় করা উচিৎ নয়। বিশেষ করে দ্রুত (র্শাপ রাইজিং) কোন শেয়ারের দাম বাড়লে বা কমলে বিনিয়োগকারীদেরকে বেশি সাবধানী হতে হবে।