ডেস্ক রিপোর্টঃ দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি এখন বেশ ভালো। গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। একই সময়ে অর্ধেকের বেশি কমেছে ঋণ বিতরণ। তার পরও ব্যাংক খাতে চলছে তীব্র তারল্য সংকট। দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি) সুদহার উঠেছে সাড়ে ১২ শতাংশে। কলমানি বাজার থেকে অর্থের সংস্থান করতে না পেরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করার প্রবণতাও বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দেশের ব্যাংক খাতে মাত্র ১৫ হাজার ৮১৭ কোটি টাকার আমানত বেড়েছিল। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৪৫ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা বা প্রায় তিন গুণ। আমানত বাড়লেও এ সময়ে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিতে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণ বেড়েছিল ৭৩ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে মাত্র ৩০ হাজার ৮২৬ কোটি টাকার ঋণ বেড়েছে। সে হিসাবে ব্যাংকের বিনিয়োগ কমে গেছে অর্ধেকের বেশি। মূলত সরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হওয়ায় চলতি অর্থবছরে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এ সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহও গত অর্থবছরের তুলনায় কম হয়েছে।
আমানতের ভালো প্রবৃদ্ধি ও ঋণ কমা সত্ত্বেও ব্যাংক খাতে তীব্র তারল্য সংকট নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলোয় যে তারল্য সংকট চলছে, তা আমানতের জন্য নয়, বরং বৈদেশিক বাণিজ্যের অস্থিরতা থেকেই সৃষ্টি। বাংলাদেশ ব্যাংক গত ছয় মাসে বাজারে ৬৭০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর মাধ্যমে বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে ৭৩ হাজার কোটিরও বেশি টাকা। আবার ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার প্রভাবেও ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিতে কালো টাকার দৌরাত্ম্যের প্রভাবও এ সংকটে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি অর্থছরের শুরুতে আমরা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়েছি। ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্য ছিল ব্যাংক ঋণের প্রবাহ কমিয়ে আমানত বাড়ানো। অর্থবছরের প্রথমার্ধের তথ্যে সেটিই দৃশ্যমান হয়েছে। এ সময়ে ব্যাংক খাতে ঋণের পাশাপাশি আমানতের সুদহার বেড়েছে। সুদহার বেশি হওয়ায় মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহী হচ্ছে। আর ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ঋণ গ্রহণ থেকে বিতরণ থাকছে। দেশের ব্যাংক খাতে এ মুহূর্তে যে তারল্য সংকট চলছে, সেটি বৈদেশিক বাণিজ্য খাত থেকে সৃষ্ট। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করায় বাজার থেকে টাকা উঠে এসেছে। আবার বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার প্রভাবেও টাকার চাহিদা বাড়ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিট ঋণ নিয়েছিল ১৮ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সরকার উল্টো ২০ হাজার ৮৬০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করেছে। গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে তা পরিশোধ করছে। গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ৩৯ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ২৭ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। মূলত ব্যাংক খাত থেকে ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের কারণে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারও দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সর্বশেষ ১৪ জানুয়ারি ৯১ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ। একই দিন ১১ দশমিক ৪০ ও ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ সুদে ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ঋণ নিয়েছে সরকার।
দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন তারল্য সংকটে। এ কারণে ভালো ব্যাংকগুলোও ১০-১২ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করছে। উচ্চ সুদেও আমানত সংগ্রহে ব্যর্থ ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও কলমানি বাজার থেকে টাকা ধার নিচ্ছে। গতকাল দেশের কলমানি বাজারে একদিন মেয়াদি ধারের সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর ৯১ দিন মেয়াদি ধারের সুদহার ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।
গত ডিসেম্বরে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার নিয়ে নিজেদের সিআরআর-এসএলআর সংরক্ষণ করেছে। ডিসেম্বরজুড়ে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ১৫ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি জানুয়ারিতেও এ ধারের প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ ১৪ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা।
দেশের ভালো ব্যাংকগুলোও এখন ১০ শতাংশের বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে বলে জানান শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ছয় মাস ধরেই ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে। সুদহার বাড়ায় আমানতের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তবে তারল্য সংকট এখনো কমেনি। ভালো ব্যাংকগুলোও এখন মেয়াদি আমানতে ১০ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে। ব্যাংক খাতে ঋণের যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তার বেশির ভাগই অনাদায়ী সুদ। গ্রাহক ঠিকমতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না। এ কারণেও ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বাড়ছে।’
প্রসঙ্গত, দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। এ কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় আমদানি দায় মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি হয়েছে ৭৬২ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি করা হয় আরো ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৬৭০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এ সময়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৯০ কোটি বা ২৭ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংকগুলোর কারণে এ পরিমাণ ডলার বিক্রি করায় বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি তারল্য চলে গেছে।
সূত্রঃ বনিক বার্তা