গুজোব ছড়ানো আইনতো দন্ডনীয় অপরাধ হলেও শেয়ারবাজারে গুজব একই সাথে আর্কষণীয় ও বিপদের বিষয়। গুজবের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ ভাগ্যক্রমে স্বল্প সময়ে ভাল হলেও, দীর্ঘ মেয়াদে লস হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এমনকী মূলধনের বড় অংশ লস হতে পারে। নানা ধরনের স্বার্থে এবং ভিন্ন ভিন্ন নতুন নতুন উপায়ে গুজব রটানো হয়ে থাকে। গুজোব সাধারণত শক্তিশালী কোন গ্রুপ ছড়ায়, যাদের পুঁজি, মেধা, দক্ষতা, গবেষণা, যোগাযোগ দক্ষতা, তথ্যে সংগ্রেহের দক্ষতা, সাধারণতো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের উপরে।
গুজবের কিছু কেীশল:– নিজের স্বার্থ লাভের জন্য এক বা একাধিক পক্ষ বাজারে গুজব ছড়ায়। গুজব কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা আসন্ন কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে হতে পারে। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এই ধরনের গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে হাতে থাকা শেয়ার লাভে বিক্রি করে দেয় অথবা স্বল্প মূল্যে বাজার থেকে শেয়ার কালেক্ট করে।
ধরা যাক গুজব ছড়ালো কোম্পানি ‘ক’ আসন্ন প্রান্তিকে ২০% লভ্যাংশ ঘোষণা করবে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রলুদ্ধ হয়ে শেয়ারটি ক্রয় করে, যার ফলে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পায়। তখন স্বার্থান্নসী গ্রুপ লাভে সেই শেয়ার বিক্রি করে দেয়। পরবর্তীতে কোম্পানি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করলে দেখা যায় লভ্যাংশের ঘোষণা সঠিক নয় অথবা গুজোবের থেকে কম লভ্যাংশে। এতে করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
আবার বিপরীতভাবে স্বার্থ লোভী পক্ষ কোন শেয়ার সম্পর্কে নেগেটিভ তথ্য গুজব আকারে প্রকাশ করে। তখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়ে সেই শেয়ার সেল করতে থাকে। ফলে শেয়ারের মূল্য হ্রাস পায়। তখন গুজব রটনাকারী ব্যক্তি বা পক্ষ স্বল্প মূল্যে সেই শেয়ার মার্কেট থেকে কিনে নেয়। কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, আইনি ব্যাপার ইত্যাদি সম্পর্কেও গুজব ছড়ানো হয়।
বড় ভলিউমে শেয়ার সেলে আতঙ্ক তৈরি:- আবার কোন প্রকার গুজোব না ছড়িয়েও বড় বিনিয়োগকারী মার্কেটে বড় ভলিউমে শেয়ার সেল করে সেল প্রেসার তৈরি করে। যা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে ভীত করে। যার কারণে তারা শেয়ার সেল করলে, বড়রা আবার কম দামে ঐ শেয়ারই বাই করে।
মাঝে হয়তো ছয় মাস বা এক বছর সময় সময় যায়। কিন্তু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সাধারণত অতো ধৈর্য নাই। অথবা তারা এমন শেয়ার ধারণ করে অপেক্ষা করে যে শেয়ারের আয় বা ভ্যালু ধারাবাহিক ভাবে কমছে। যার কারণে তারা বেশি লুজার হয়।
সব শেয়ার নিয়ে মার্কেটে গুজোব ছড়ায় না। কী কী বৈশিষ্ট থাকলে প্লেয়াররা ঐ শেয়ার নিয়ে গুজোব ছড়ায় সে বিষয়ে অনেকের ধারণা কম থাকে।
গুজব ছড়ানোর সহজ স্থান:- গুজব ছড়ানোর সবচেয়ে সহজ জায়গা হচ্ছে ফেইসবুক। শেয়ারবাজারকে ঘিরে ফেইসবুকে অনেকগুলো গ্রুপ ও পেজ রয়েছে। এসব গ্রুপগুলোতে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ ভিজিট করে। সুতরাং এখানে কোন বিষয় সম্পর্কে গুজব ছড়ালে তা সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আর এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থান্বেষী দলগুলো এক যোগে গুজব ছড়াতে থাকে। একই গ্রুপ নানা নামে পেজ খুলে। মানে বলা যেতে পারে শেয়ারের নাসে সমান্বিত বিঙ্গাপণ দেয়। মানুষ এখন ডিজিটাল জুগে বসবাস করছে। নিমিষেই তথ্য এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত করতে পারছে। সুতরাং গুজব ছড়ানোর পর তা মহামারী আকারে বিনিয়োগকারীদের মাঝে ছড়িয়ে পরছে।
অনেক সময় দেখা যায় ব্রোকার হাউজে দায়িত্বে থাকা লোকজনের মাধ্যমেও গুজব ছড়ায়। তারা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন কোম্পানি সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রদান করতে পারে। আর যেহেতু বিভিন্ন হাউজের ব্রোকারদের মধ্যে যোগাযোগ থাকে তাই অল্প সময়েই গুজব বেশীরভাগ হাউজে ছড়িয়ে পরে।
তখন সেই হাউজের অ্যাকাউন্টধারী বিনিয়োগকারীরা প্রলোভিত হয়ে গুজবে পা দেয়। এক জন বিনিয়োগকারীর কানে গুজব গিয়ে পৌঁছালে সেই বিনিয়োগকারীর মাধ্যমেই গুজবটি আরও ১০ জনের কানে গিয়ে পৌছায়। ফলশ্রুতিতে গুজবকেই সঠিক তথ্য বলে মনে হয়।
তাছাড়া কোনও কোম্পানির বড় কর্মকর্তার নিয়োজিত লোক বা গ্রুপ দ্বারাও বাজারে গুজব ছড়ানো হয়। সাধারণত কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক, গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ব্যক্তিরা নিজ বা অন্য প্রতিষ্ঠানের অপ্রকাশিত তথ্য সম্পর্কে আগেই জেনে যায়।
তখন তারা কম মূল্যে বাজার থেকে শেয়ার কালেক্ট করে। কমদামে শেয়ার কালেক্টশন শেষ উচ্চ দামে শেয়ারগুলিকে বিক্রয় করতে হবে। তারা ভাড়াটে লোকবল ব্যবহার করে বিভিন্ন মাধ্যমে কোম্পানির অপ্রকাশিত তথ্য গুজব আকারে জানিয়ে দেয়।
শেয়ারের ডিমান্ড(চাহিদা) সৃষ্টি:- শেয়ারের ডিমান্ড বাড়াতে শুরু হয় নানা মাধ্যমকে ব্যবহার করে সমান্বিত বিঙ্গাপণের (গুজোব) মাধ্যমে ডিমান্ড (চাহিদা) সৃষ্টি। বিঙ্গাপণের (গুজোব) মাধ্যমে মানুষকে লোভাতুর করে তোলা হয়। যার কারণে শেয়ারের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, সেই সাথে গুজোব সৃষ্টি কারীরাও কিছু শেয়ার ক্রয় করে অথবা নিজেদের মধ্যে ক্রয় বিক্রয় করে কিন্তু বিক্রয় করে বেশি।
যেহেতু কম দামে তারা বিপুল সংখ্যক শেয়ার বাই করেছে , সে কারণে একদিকে মার্কেটে সাপলাই (শেয়ার সেল করা) আর অন্যদিকে তারাও নিজেদের পোর্টফলিওর মধ্যে শেয়ার কেনা-বেচা করে কিছুটা কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে। শেয়ারটির দাম একটা লেভেলে না পেীঁছান পর্যন্ত। যার কারণে দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায় ক্ষুদ্ররা কিছু বুঝে উঠার আগেই। বৃদ্ধি পাওয়া দামে এবার তারা শেয়ারের বিক্রেতা… তাহলে উচ্চদামে ক্রেতা কে? গুজবে আশান্বিত হওয়া ক্ষুদ্র ট্রেডাররা। শেয়ারটি কমদামে ছয়মাস বা এক বছর পড়ে ছিল তখন তারা ক্রয় করেনি। কিন্তু এখন দর বৃদ্ধি পেয়ে বছরের সর্বউচ্চ দামে এসেছে এখন ক্রয় করবে….
অবশ্য গুজোবেব প্রথম পর্যয়ে শেয়াব বাই করে কেউ লাভবান হয়। কিন্তু একবার লাভ করলে অন্য বার লস হয়। বছর শেষে দেখা যায় মূলধন থেকে একটা অংশ নাই। মানুষ অতি অল্প সময়েই ধনী হতে চায়। এটি মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। ফলে লোভনীয় গুজব পরিহার করে চলা সবার পক্ষে কষ্টসাধ্য।
পরিত্রাণের উপায়: ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যারা শেয়ারবাজারে গুজব এড়িয়ে নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগ করে তারাই সফলকাম হয়। সুতরাং বিনিয়োগকারী হিসেবে গুজবে কান না দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। সঠিকভাবে টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে গুজোবের সঠিক সময়ে শেয়ারটি ক্রয় ও বিক্রয় করে অনেকে দ্রুত সময়ে প্রচুর মুনাফা করে। এ বিষয়ে দক্ষতা আনতে প্রয়োজন টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ প্রশিক্ষণ, অভিঙ্গতা, ও চৌকস হওয়া, সময়ের ট্রেন্ড সর্ম্পকে ধারণা।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ হলো গুজোব এড়িয়ে, কোম্পানির আসল ভেল্যু ও বর্তমান বাজার দামের বিবেচনায় নিয়ে আন্ডারভেলুড দামে শেয়ার ক্রয় করবেন এবং কোম্পানির কার্যক্রমের উপর সর্তক দৃষ্টি রাখবেন।
– সংগ্রহীত