ডেস্ক রিপোর্টঃ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চলতি অর্থবছরের শুরুতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজারে অর্থের প্রবাহ কমাতে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। কমিয়ে আনা হয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যও। আমদানি কমিয়ে আনা হয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। শিল্পের উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি এ সময়ে বাজারে পণ্যের চাহিদারও পতন হয়েছে। কিন্তু বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোট বা নগদ অর্থ সরবরাহের ক্ষেত্রে। গত নভেম্বরের পর বাজারে ছাপানো অর্থের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুনের পর থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ কমে আসছিল। কিন্তু অক্টোবরে এসে ছন্দপতন হয়। ওই মাস শেষে বাজারে ইস্যুকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা ছিল ব্যাংক খাতের বাইরে। এর পর থেকে ইস্যুকৃত নোট ও ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে। সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যুকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকায়। সে হিসাবে আড়াই মাসের ব্যবধানে ১০ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা বাড়ে ছাপানো অর্থ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের নভেম্বর থেকে ব্যাংকগুলোয় নগদ টাকা উত্তোলনের চাপ বেড়ে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। আবার নানা অনিশ্চয়তার কারণে একশ্রেণীর গ্রাহকও টাকা তুলে নিয়েছেন। অর্থ সংকটে পড়ায় কিছু ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তারল্য সহায়তাও দেয়া হয়েছিল। এসব কারণে সংকোচনমূলক নীতির পরও ইস্যুকৃত নোটের পাশাপাশি ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোট রেকর্ড ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ওই মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসে ইস্যুকৃত এত পরিমাণ নোট ও ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থ অতীতে কখনই ছিল না। এরপর জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বাজারে অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার (রেপো রেট) বাড়ানো হয়। তুলে নেয়া হয় ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশের সীমাও। এরপর দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার ক্রমাগত বাড়ছে। চলতি ফেব্রুয়ারিতে সর্বোচ্চ সুদহার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশে। সে হিসাবে গত সাত মাসে ঋণের সুদহার ৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।

মূল্যস্ফীতির হার কমানোর কথা বলে সুদহার বাড়ানো হলেও সেটির প্রভাব এখনো দৃশ্যমান হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। পুরো ২০২৩ সালেই সে হার ৯ শতাংশের বেশি ছিল। যদিও অর্থনীতিবিদদের দাবি, দেশের প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার বিবিএসের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।

একটি দেশের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ ইস্যুকৃত নোট থাকবে সেটির একটি আদর্শ অনুপাত রয়েছে। ২০২০ সালের আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যুকৃত নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ব্যাপক মুদ্রার (ব্রড মানি) সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে কভিডসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে এ অনুপাত কিছুটা বেড়ে যায়। তার পরও ২০২১ সালের জুনে ব্যাংকের বাইরে ছিল ব্যাপক মুদ্রার সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। ২০২২ সালেও এটি ১৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত বছরের জুনে এ অনুপাত ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যায়। ডিসেম্বরে এসে এটি কিছুটা কমলেও তা প্রায় ১৫ শতাংশ রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য হলো প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটায় বর্তমানে এ অনুপাত সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক নীতি ও ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকদের আস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় গত বছরের মাঝামাঝিতে ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ কমতে শুরু করে। একই সঙ্গে কমে আসে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণও। জুলাইয়ে এসে ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৯২ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। আর আগস্টে ২ লাখ ৮২ হাজার ৪৮৭ কোটি এবং সেপ্টেম্বরে তা ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩১২ কোটি টাকায় নেমে আসে। সে হিসাবে জুনের তুলনায় অক্টোবর শেষে ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ কমে ৩৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। কিন্তু নভেম্বর থেকে ছাপানো এ নোটের সংখ্যা আবারো বাড়তে শুরু করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট ইস্যুকৃত ছাপানো টাকার ৯২ শতাংশই উচ্চমূল্যের তথা ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট। গত জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত ৫০০ টাকার নোট ছিল ২৩৫ কোটি ৯২ লাখ ৬৯ হাজার ৯১৬টি। এসব নোটের মূল্যমান ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৬৩ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, যা মোট ইস্যুকৃত অর্থের ৩৮ শতাংশ। আর বাজারে ১০০০ টাকার নোট ছিল ১৬৮ কোটি ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৬২৬টি, যার মূল্যমান ১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৭ কোটি ৯৬ লাখ ২৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ বাজারে ইস্যুকৃত অর্থের ৫৪ শতাংশেরও বেশি ছিল ১০০০ টাকার নোট। সব মিলিয়ে গত জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি।

সূত্রঃ বনিক বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here