কিছুদিন আগে আমার এক সহকর্মী আমাকে বললেন, ডলার এত শক্তিশালী মুদ্রা কেন? আমি বললাম, যেহেতু আমেরিকার অর্থনীতি পুরো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের মুদ্রার মাধ্যমে প্রায় সব অর্থনৈতিক কাজকর্ম চলবে, তাহলে এটাই তো স্বাভাবিক। তাই বলে যুগের পর যুগ। ওনাকে একটু হতাশ মনে হলো।
বললেন, কখন থেকে তাদের এ আধিপত্য চলছে এবং কেন অন্য দেশগুলো পারছে না? তাহলে তো পেছনে ফিরে যেতে হয়। একসময় মুদ্রার মান নির্ধারণ হতো স্বর্ণমানের ভিত্তিতে। ইতিহাসের প্রায় অনেক সময় ধরে স্বর্ণ ছিল পছন্দনীয় মুদ্রা। লিডিয়ায় (বর্তমান তুরস্ক) খ্রিস্টপূর্ব ৬৪৩ সালে প্রথম স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। রাজা ক্রিসাস প্রথম স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার করেন।
সে সময়ে মুদ্রার মান নির্ধারিত হতো মুদ্রার মধ্যে যতটুকু স্বর্ণ থাকত, তার ওপর। তখন যে দেশের কাছে যত বেশি স্বর্ণ মজুদ থাকত, সে দেশের মুদ্রার মান তত বেশি শক্তিশালী বলে ধরা হতো। এজন্য স্পেন, পর্তুগাল ও ইংল্যান্ড নতুন পৃথিবীর সন্ধানে পাঠিয়েছিল কলম্বাস ও অন্য আবিষ্কারকদের। ধনী হওয়ার জন্য তাদের অনেক স্বর্ণমুদ্রার প্রয়োজন ছিল।
১৮৪৮ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় স্বর্ণ পাওয়া গেলে হইচই পড়ে যায় স্বর্ণ উত্তোলনের, যা ইতিহাসে ‘গোল্ড রাশ’ নামে পরিচিতি পায়। ১৮৬১ সালে আমেরিকার ট্রেজারি সেক্রেটারি স্যামন চেজ কাগুজে মুদ্রা চালু করেন, যা পরে ডলার হিসেবে পরিচিতি পায়। স্বর্ণমান আইন অনুসারে মুদ্রাকে শুধু স্বর্ণের সঙ্গে বিনিময় করা যেত। এই আইন অনুসারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২০ দশমিক ৬৭ ডলারে নির্ধারিত হয়।
সারা দুনিয়ায় বাণিজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাণিজ্য সুবিধার জন্য অধিকাংশ দেশ স্বর্ণমান অনুযায়ী বাণিজ্য করার জন্য প্রলুব্ধ হয়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ তাদের মুদ্রাকে স্বর্ণের সঙ্গে বিনিময়যোগ্য করে। বিনিময় এখন ভারী ভারী স্বর্ণমুদ্রার বদলে কাগুজে নোটের মাধ্যমে শুরু হলো। স্বর্ণমুদ্রার সঙ্গে কাগুজে নোটের পাকাপোক্ত সম্পর্ক তৈরি হলো। যেহেতু স্বর্ণ আবিষ্কারের নেশা দেশগুলোকে পেয়ে বসল, স্বর্ণের জোগান অনেক বেড়ে গেল। অর্থনীতির বিধান অনুসারে, স্বর্ণের দাম ও মুদ্রার মূল্য কমতে লাগল।
এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকার কংগ্রেস স্বর্ণ ও মুদ্রার মানের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ১৯১৩ সালে ফেডারেল রিজার্ভ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু এর কাজ শুরু হওয়ার আগেই শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইউরোপের দেশগুলো সামরিক ব্যয় মেটানোর জন্য স্বর্ণমান ছেড়ে বেশি বেশি মুদ্রা ছাপাতে শুরু করল। কিন্তু এতে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির (হাইপার ইনফ্লেশন) সৃষ্টি হলো।
যুদ্ধের পরে দেশগুলো তাদের মুদ্রাকে আবার পরিবর্তিত স্বর্ণমানের সঙ্গে বেঁধে দেয়। ১৯২৯ সালে আমেরিকায় মহামন্দা শুরু হলে দেশগুলো আবার স্বর্ণমান ত্যাগ করাতে স্টক মার্কেটের পতন হয়। বিনিময় হতে লাগল মুদ্রা ও দ্রব্যের ভিত্তিতে। স্বর্ণের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন ডলার ভাঙাতে শুরু করল এবং বেশি বেশি স্বর্ণ কিনতে লাগল। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে থাকল, ব্যাংকগুলো পতন শুরু হলো, মানুষ আরো বেশি স্বর্ণের প্রতি ঝুঁকে পড়ল।
এ অবস্থা রোধে ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়ে দিল, যাতে স্বর্ণ মজুদের প্রবণতা হ্রাস পায় এবং ডলারের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু সুদের হার বাড়ানোয় ব্যবসার খরচ বেড়ে যায়। মন্দা প্রবণতা আরো বেড়ে গেল। অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হলো। বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছল। ১৯৩৩ সালের ৩ মার্চ নতুন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ব্যাংক বন্ধ করে দিলেন, যাতে করে স্বর্ণ ভাঙানোর প্রবণতা রোধ করা যায়। এ মাসের ১৩ তারিখে তিনি আবার ব্যাংক খুলে দিলেন। ব্যাংকগুলো তাদের ভল্টে রক্ষিত সব স্বর্ণ ফেডারেল রিজার্ভে জমা করল।
আইন করে ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের বিনিময়যোগ্যতা বাতিল করা হলো। স্বর্ণের মজুদ বন্ধে তিনি আমেরিকানদের আহ্বান করলেন স্বর্ণ জমা দিয়ে ডলার নেয়ার জন্য। জনগণ তার ডাকে সাড়া দিল। কিছুদিনের মধ্যে আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বর্ণ মজুদকারী দেশে পরিণত হলো। এরপরে লাইসেন্স ছাড়া স্বর্ণের মজুদ নিষিদ্ধ করা হলো। এসব কারণে সরকার ডলারের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অর্জন করল।
প্রেসিডেন্ট আইনের মাধ্যমে ডলারের দাম ৪০ শতাংশ কমালেন। স্বর্ণের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে ডলারের দাম কমানো হলো। প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২০ দশমিক ৬৭ ডলার হতে ৩৫ ডলারে উন্নীত হলো, সরকারের স্বর্ণের মজুদ ৪ বিলিয়ন ডলার হতে বেড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলো। ডলারের কার্যকরীটা ৬০ শতাংশ কমে গেল।
১৯৩৯ সালে মন্দার অবসানের পর দেশগুলো আবার পরিবর্তিত স্বর্ণমানে ফিরে গেল। ১৯৪৪ সালে ট্রেটন উডস সিস্টেমের মাধ্যমে স্বর্ণের ভিত্তিতে সব মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। দেশগুলো তাদের মুদ্রার বৈদেশিক হোল্ডিংকে স্বর্ণে রূপান্তর করল। স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে ৩৫ ডলারে নির্ধারণ হলো।
যুক্তরাষ্ট্রে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের মজুদ। এর কারণে অনেক দেশ তাদের মুদ্রাকে স্বর্ণের বদলে ডলারের সঙ্গে স্থির (pegging) করল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের মুদ্রা ও ডলারের মধ্যে স্থির বিনিময় মূল্য হার নির্ধারণ করল। তাদের মুদ্রার মান যখন ডলারের বিপরীতে অনেক কমে যেত, তখন তারা বৈদেশিক মুদ্রার বাজার থেকে নিজ দেশের মুদ্রা কিনত।
যদি তাদের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে বেড়ে যেত, তখন তারা অনেক মুদ্রা ছাপাত এবং তা বিক্রয় করত। এ ধরনের স্থিরকরণের মাধ্যমে দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য করাটা অনেক সুবিধাজনক হলো। বাণিজ্যের এ পর্যায়ে অনেক দেশের কাছে স্বর্ণের সঙ্গে তাদের মুদ্রার মূল্যমান নির্ধারণের আর প্রয়োজনীয়তা রইল না। স্বর্ণের জায়গা দখল করল ডলার। এতে ডলারের দাম বেড়ে গেল যদিও এর স্বর্ণমূল্য একই রয়ে গেল।
এ প্রক্রিয়ায় ডলার বৈশ্বিক মুদ্রায় পরিণত হলো। সত্তরের দশকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অর্থনৈতিক নীতির কারণে মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা তৈরি হলে তিনি ডলারের দাম ক্রমান্বয়ে কমালে ডলারের প্রতি মানুষের আস্থা কমে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে গেল। ব্রেটন উডস সিস্টেমের অবসান হলো। স্বর্ণমান যুগের অবসানের পর দেশগুলো কাগজের নোট ছাপাতে শুরু করল। যার কারণে সৃষ্টি হলো মুদ্রাস্ফীতির।
তথাপি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বেড়ে গেল। তাই বলে প্রকৃত সম্পদ হিসেবে স্বর্ণের আবেদন কখনো কমেনি। যখন কোনো মন্দা বা মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়, তখন বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ স্বর্গ হিসেবে স্বর্ণে বিনিয়োগেই ফিরে যান।
লেখক, কাজী নাইম মোরশেদ, ব্যাংকার | সংগ্রহীত